সর্বোচ্চ শাস্তির মাধ্যমে মানুষের জীবনে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ে না এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। বরং শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি, তার সন্তান, আত্মীয়স্বজন সবার ভেতরে একটা ক্রোধ আমৃত্যু থেকেই যায়। মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, মৃত্যুদণ্ডে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়।
মৃত্যুদণ্ডকে নিষ্ঠুরতম শাস্তি বিবেচনায় কিছু উন্নত দেশসহ বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশ তাদের বিচারিক ব্যবস্থা থেকে সর্বোচ্চ শাস্তিকে বাদ দিয়েছে। সেসব দেশের অভিমত হলো, মৃত্যুদণ্ড কোনো অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তারপরও এখনও অনেক উন্নত দেশসহ কিছু দেশ, যেমন— যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া হত্যা, গুপ্তচরবৃত্তি, বিশ্বাসঘাতকতা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে প্রাণদণ্ডের বিধান রেখেছে।
মৃত্যুদণ্ডের প্রশ্নে মহামান্য হাইকোর্ট বলেছেন, দেশ ও দেশের বাইরে অপরাধীরা যেসব অপরাধ করছে— তা উদ্বেগজনক ও ভয়ানক। এ কারণে দেশ ও দেশের বাইরে মৃত্যুদণ্ড যথাযথ শাস্তি হিসেবে প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, নাগরিকদের আইন মেনে চলা এবং বেআইনি কর্মকাণ্ড বন্ধে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট নাগরিকদের সতর্ক করে।
এই শাস্তি আরও বার্তা দেয় যে, যদি কোনো ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে। কেউ যদি অনৈতিকভাবে কাউকে হত্যা করে, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ সাজা দেয়ার বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না বলে অভিমত তুলে ধরেন বিচারপতি নজরুল। মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পরে, দণ্ডিত ব্যক্তির পরিবার-পরিজন সবার ভেতরে একটা ক্ষোভ থেকেই যায়। যা চলে আমৃত্যু। তাছাড়া একজনের কাছে ভয়ংকর অপরাধী অন্য কারও কাছে হয়তো নির্দোষ। সুতরাং সব বিষয়ের মতো এখানেও আপেক্ষিকতা আছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যান বলছে, বহু দেশ মৃত্যুদণ্ডের বিধান থেকে সরে এলেও অনেক দেশে এ ধরনের দণ্ড এখনো আইনিভাবে স্বীকৃত এবং জনপ্রিয়। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২২ সালে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই, গত বছর বিশ্বে ৮৮৩টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
অ্যামনেস্টির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সাল থেকে ২০২২ সালে বিশ্বে মৃত্যুদণ্ডের হার ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। চীন বাদে বিশ্বের ৯০ শতাংশ মৃত্যুদণ্ডই কার্যকর হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার তিনটি দেশে। এদের মধ্যে ইরানে ৫৭৬ জন, সৌদিতে ১৯৬ জন, মিসরে ২৪ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
গত বছর যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা হয়েছে, তার মধ্যে শীর্ষে আছে চীন। দেশটিতে ২০২০ সালে ৪৮৩টি মৃত্যুদণ্ডের তথ্য রয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে। সংস্থাটির হিসাবে এর পরের অবস্থানে থাকা দেশগুলো হলো ইরান, মিসর, ইরাক ও সৌদি আরব।
বাংলাদেশের নামও আছে অ্যামনেস্টির এই তালিকায়। সংস্থাটি বলছে, গত বছর বাংলাদেশে ১১৩টির বেশি মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা হয়েছে, সাজা কার্যকর হয়েছে দুটি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো— মৃত্যুদণ্ড দিয়ে কি অপরাধ বন্ধ করা যায়? ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ২০১৮ সালে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো শিশুকে ধর্ষণ করার জন্য এবার থেকে ফাঁসির সাজা দেয়া হবে। আইন সংশোধন করতে একটি অর্ডিন্যান্স জারির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। যেদিন শিশু-ধর্ষণের জন্য ফাঁসির সাজা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ঠিক সেদিনই মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে ৮ মাস বয়সী এক সদ্যোজাত কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করে খুন করার অভিযোগে একজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল।
তারপরে যদি আরও জানতে চাই— তাহলে দেখা যাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত নিয়ে একটু পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা যেতে পারে। নারীদের জন্য বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক রাষ্ট্র ভারত। ভারতে গাড়িতে, প্রকাশ্য রাস্তায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তথা যে কোনো স্থানে নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।
ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর এক হিসাব থেকে জানা যায়, ২০১২ সালে ২৪,৯২৩টি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪,৪৭০টি ঘটনায় ধর্ষকের ভূমিকায় পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও অন্যান্য পরিচিতজন। অর্থাৎ প্রায় ৯৮ শতাংশ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে তাদেরই পরিচিতজন দ্বারা। সর্বশেষ প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভারতে প্রতি ২২ মিনিটে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়।
আর কথায় কথায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ছবক দেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধর্ষণ অপরাধে বিশ্বে এক নম্বর রাষ্ট্র। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারী স্বয়ং সেখানে ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এমন মার্কিন নাগরিকের মধ্যে ৯১ শতাংশ হচ্ছে নারী, বাকি ৯ শতাংশ হচ্ছে পুরুষ।
ন্যাশনাল ভায়োলেন্স এগিয়েনস্ট উইমেন সার্ভের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের প্রতি ৬ জনের একজন এবং পুরুষদের প্রতি ৩৩ জনের একজন জীবনে একবার হলেও ধর্ষণের পূর্ণ কিংবা আংশিক শিকার হয়েছেন। ঘটনা ঘটেছে ভিকটিমদের ঘর-বাড়িতেই।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করার পর থেকে অনেক দেশই মৃত্যুদণ্ডের বিধান রোহিত করছে। সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে এ ধরনের শাস্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দ্য কাউন্সিল অব ইউরোপ। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ফেডারেল বিচার ব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ড বিলোপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
বাংলাদেশের আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেশে ‘জনপ্রিয়’ হলেও আধুনিক বিশ্ব পরিস্থিতিতে এটি পর্যালোচনার সময় এসেছে। দেশে বেশ কিছু ফৌজদারি অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে রয়েছে মৃত্যুদণ্ডের বিধান। ‘দণ্ডবিধি, ১৮৬০’ এর যে ১০টি ধারায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে, সেগুলো হলো— ১২১, ১৩২, ১৯৪, ৩০২, ৩০৩, ৩০৫, ৩০৭, ৩২৬ (ক), ৩৬৪ (ক) এবং ৩৯৬।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়ে থাকে বাংলাদেশ তার একটি। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মৃত্যুদণ্ড প্রসঙ্গে বলেন, ‘অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিশ্বের অনেক দেশই বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশেও মৃত্যুদণ্ডের বিধান বহাল রাখার আর প্রয়োজন নেই। তার কারণ, অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে আমৃত্যু কারাদণ্ডই একটি বড় শাস্তি। এটা কার্যকর করা গেলে আর মৃত্যুদণ্ডের প্রয়োজন হয় না, যদিও বিষয়টি নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর।’
মৃত্যুদণ্ড বাতিল করলে অপরাধ বেড়ে যাবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক আইনমন্ত্রী বলেন, ‘যে কারণে মৃত্যুদণ্ড হয়, সেই কারণগুলো নির্ণয় করে যদি রোহিত করা যায়, তাহলেই হবে। এটা হলে আর অপরাধের সংখ্যা বাড়বে না।’
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারক বিচারপতি নিজামুল হকও সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করছেন না। তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, মৃত্যুদণ্ড পৃথিবী থেকে তুলে দেয়া উচিত। কারণ, মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। যদিও এ ক্ষেত্রে সময় লাগবে, এর জন্য ক্যাম্পেইন করা দরকার। আমাদের সামনে আগাতে অনেক সময় লাগবে। তবে আমাদের এমন একটা লক্ষ্য থাকা উচিত, যাতে পৃথিবীতে কোথাও মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকে।’
মানবাধিকার কর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, ‘আমরা আসলে যে কোনো অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে সব সময়ই মৃত্যুদণ্ড দাবি করে আসছি। সবার দাবিই থাকে মৃত্যুদণ্ড। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হলো, লিগ্যাল সিস্টেমে অনেক সময় ব্যক্তি নির্দোষ হয়। শতভাগ নির্ভুল বা নিশ্চিতভাবে কারও অপরাধ প্রমাণ করে সাজা হয়েছে এমনটা কি আমরা বলতে পারব?’
মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে মনে হয়, সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে মৃত্যুদণ্ড দেয়া আদৌ সম্ভব কিনা! তাছাড়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়ে অপরাধ সেই অর্থে কমানো গেছে এমনটা বলা যাবে না। কারণ মৃত্যুদণ্ড অনেক পুরনো বিধান। এটা থাকা সত্ত্বেও অপরাধ কমেনি বরং বাড়ছেই। সেকারণে মৃত্যুদণ্ড রাখা উচিত কিনা এটা ভাবা যেতে পারে। এক্ষত্রে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ‘১৯৬৬ সালে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। ওই চুক্তির ২ নম্বর ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড নিরোধের সিদ্ধান্ত আসে। সেটি বিশ্বের অনেক দেশ কার্যকর করলেও এখনো বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান একটি বৈধ সাজার পদ্ধতি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এই বিধান নিরোধ করা নিয়ে সেভাবে কাজ শুরু হয়নি।’
বাংলাদেশের বেশিরভাগ আইন ব্রিটিশ আইন থেকে এসেছে। এই আইনগুলোতে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট (সর্বোচ্চ সাজা) কী হবে তা বলা আছে। আইনগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের সাজা লিগ্যাল। তবে একইভাবে চিন্তা করতে হবে, আমাদের যে সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেখানে মৃত্যুদণ্ডের বিপরীতে আমৃত্যু বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান কতটুকু প্রত্যাশিত।
মানবকণ্ঠ/এফআই